৬০ শতাংশ পদ খালি, অথচ ডাবল শিফট করে বাড়ছে শিক্ষার্থী। কারিগরি শিক্ষাকে দক্ষ জনশক্তি তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে বার বার।ঘোষণা দেয়া হচ্ছে এ শিক্ষার
মর্যাদা বৃদ্ধিরও। কিন্তু ভয়াবহ শিক্ষক সঙ্কট নিয়ে ডাবল শিফট চালু, বেতন না পাওয়া, ক্লাস
না হওয়া, শিক্ষক ছাড়া বিভাগ খুলে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ বহুমুখী অব্যবস্থাপনায় ভেঙ্গে পড়েছে দেশের
সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রম।অবহেলার শিকার হয়ে চরম সঙ্কটের
মুখে ৪৯ সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। সঙ্কট এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, প্রতিবছর হাজার হাজার নতুন
শিক্ষার্থী নিয়ে ডাবল শিফটে শিক্ষাদান চললেও রাজস্বভুক্ত ২০ পলিটেকিনিকে খালি পড়ে আছে ৬০ শতাংশ শিক্ষকের পদ। প্রকল্পভুক্ত ২৯টিতে ৮০ শতাংশ পদে কোন শিক্ষকই নেই। নেই কোন পদোন্নতি। কেবল তাই নয়, ৪৯টির মধ্যে ৪৫টিতেই নেই উপাধ্যক্ষ। খোদ অধ্যক্ষ ছাড়াই চলছে ২৮টি পলিটেকনিক। কোন শিক্ষক ছাড়াই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে অসংখ্য বিভাগ। যেখানে শিক্ষার্থীদের চার বছরের ডিপ্লোমা পাসের পর
উচ্চ শিক্ষার পথও প্রায় বন্ধ। এদিকে কারিগরি শিক্ষার বহুযুগের এই সঙ্কট উত্তরণে আন্দলন করছেন শিক্ষক ও শিক্ষাত্রিরা এবং শীঘ্রই বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা । শিক্ষকরা বলছেন, কারিগরি দক্ষ
জনশক্তি তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত ও এর মর্যাদা বৃদ্ধির কথা সরকারীভাবে বার বার
বলা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। যেখানে শিক্ষকের চরম সঙ্কটে এক শিফটের কার্যক্রমেই চলছে না সেখানে নতুন শিক্ষক ছাড়াই প্রথম শিফটের সমান শিক্ষার্থী নিয়ে সারাদেশে খোলা হয়েছে ডাবল শিফট। সেই শিফটে দায়িত্ব পালনের জন্য নেই অর্থ বরাদ্দ। ফলে তৈরি হয়েছে সঙ্কটের ক্ষেত্র। শিক্ষকরা দাবি তুলেছেন, হয়
দ্বিতীয় শিফটে শিক্ষক নিয়োগ অন্যথায় ১০০ ভাগ বেতন দিলেই কেবল অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন।
দাবি বাস্তবায়নে শীঘ্রই বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিক্ষকরা।তাঁরা আক্ষেপ করে বলেন, এমন সঙ্কট রেখে ডিল্পোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো প্রায়োগিক শিক্ষা প্রদান
করা মানে হচ্ছে শিক্ষার নামে প্রহসন। অন্যদিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা সরকারের
কাছে দ্রুত সঙ্কট নিরসনের দাবি জানিয়ে বলেছেন, আমাদের
শিক্ষা জীবন বাঁচান। দেশের সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে মোট ৪৯টি। যার
মধ্যে পুরাতন ২০টি রাজস্বভুক্ত। ২৯টি চলছে কয়েকটি প্রকল্পের
অধীনে। এ ছাড়া আছে তিনটি সরকারী মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট বা একটি বিভাগ নিয়ে চলা সরকারী পলিটেকিনিক। সকালের প্রথম শিফটে ১২ হাজার ও বিকেলের দ্বিতীয় শিফটে ১২ হাজারসহ প্রতিবছর অন্তত ২৪ হাজার নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে। গত তিন বছর ধরে নেয়া হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা। দেশের
৪৯টি সরকারী পলিটেশনিকে ৩২টি টেকনোলজিতে চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। মধ্যম স্তরের কারিগরি শিক্ষার মধ্যে আট ধরনের ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে। এগুলো হলো ডপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, মেরিন, টেক্সটাইল, ফরেস্ট্রি, অ্যানিমেল
অ্যান্ড প্রোডাকশন টেকনোলজি, ভোকেশনাল এডুকেশন ও ডিপ্লোমা ইন হেলথ। কিন্তু শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় পদে পদে নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া এসএসসি ভোকেশনাল ওএইচএসসি ব্যবসায়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কয়েক লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদেরওসমস্যার শেষ নেই। প্রতিষ্ঠানেরসিলেবাসেও নতুনত্ব নেই।মান্ধাতা আমলের সিলেবাস দিয়েই চলছে শিক্ষা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে নানা সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেয়ায় এর প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের
আগ্রহও বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যে সঙ্কটের কথা বলে আসছে তার সমাধানের নেই কোন উদ্যোগ। সরকারীভাবে বার বার সমস্যা সমাধানের ওয়াদা দেয়া হলেও ফল শূন্য। কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর ও ইন্সট্রাক্টর পদের মর্যাদা বৃদ্ধির
জন্য জুনিয়র লেকচারার, লেকচারার, প্রফেসর প্যাটার্নের চাকরি কাঠামো সরকার বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত শিক্ষকরা সেই মর্যাদা পাননি। ইন্সট্রাক্টর ও ইন্সট্রাক্টর পদের এমএ, এমএসসি,
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, এমএস-ইন- ইঞ্জিনিয়ারিং এমনকি পিএইচডি করেওশিক্ষকরা জুনিয়র লেকচারার,
লেকচারার, প্রফেসর প্যাটার্নের মর্যাদা পাননি। শুধু তাই নয়,প্রকল্পভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের
একই আশ্বাস দেয়া হলেও বিশেষ এসআরও জারির মাধ্যমে কর্মচারীদের আজও রাজস্বভুক্ত করা হয়নি। এসব
কারণে বর্তমানে দেশের ৪৫টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে নতুন করে চালুকৃত দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষা কার্যক্রম
চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ৮০ ভাগ শিক্ষক সঙ্কট নিয়েই ওই শিফট চালু করা হয়েছে। অপরদিকে যে ক’জন
শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, তাদেরও ঠিক মত বেতন- ভাতা দিচ্ছে না সরকার। ওইসব শিক্ষক সবাই প্রথম শিফটের।
বাড়তি ক্লাস নেয়ার বিনিময়ে তাদের মূল বেতনের ৪০ ভাগ সম্মানী দেয়ার কথা ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করা দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। এদিকে কেবল এসব প্রতিষ্ঠানই নয়, খোদ কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদেও এক বছরের
বেশি সময় ধরে নেই কোন স্থায়ী কর্মকর্তা।কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যানই চালাচ্ছেন অধিদফতর।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি ইনস্টিটিউটের একই সঙ্কট।
শিক্ষক সঙ্কট তুলনামূলকভাবে কম আছে সবচেয়ে বড় ঢাকা পলিটেকনিকে ইনস্টিটিউটে।
কিন্তু এখানে আছে বহুমুখী সঙ্কট। নেই শিক্ষকদের কোন পদোন্নতি। এখানে এনভায়রনমেন্টাল
টেকনোলজি বিভাগ খোলা হয়েছে। ভর্তি হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও। কিন্তু নেই একজনও নিজস্ব শিক্ষক। অন্য
বিষয় থেকে শিক্ষক ধার এনে কিংবা একই বিভাগ থেকে পাস করা ছাত্রদের দিয়ে কোনমতে কাজ চলছে।
আছে আরও জনপ্রিয় সব বিষয়ে একই সমস্যা। এদিকে শিক্ষার্থীরা এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে কিছু অসৎ ছাত্র নেতা নামধারী ব্যক্তিকে। গত কয়েকমাস ধরে এদের দাপটে শিক্ষকরাও ঠিকমতো ক্লাস
নিতে পরেন না। জোর করে ক্লাস বন্ধ করে ছাত্রদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন গোপন কক্ষে পালিয়েও রক্ষা পায় না সাধারণ ছাত্ররা। কিছু নেতারা এই দৌরাত্ম্য এখানে থাকে সব সময়। ছাত্ররা এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চেয়েছে। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-ছাত্ররা হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ৪০ বছর পরও তাদের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন হয়নি। ৫টি হোস্টেল থাকলেও কোনমতে কার্যকর একটা মহিলা হোস্টেলই। বাকি ৪টি হোস্টেল এখনও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। প্রতি শিফটে ৭৫ জন শিক্ষকসহ দুই শিফটে ১৫০ জন শিক্ষক থাকার কথা কিন্তু নেই ৫০ জনও। শিক্ষক স্বল্পতায় ক্লাস হয় না। দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষকদের ৪০ শতাংশ বেতন সরকারীভাবে দেয়ার কথা কিন্তু ১৩ মাস ধরে তাও বন্ধ। শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। ৪টি বিভাগের ৫টি সেমিস্টারে ৩৮ শিক্ষক পদের মধ্যে আছেন মাত্র ৫ জন। ৩০ জন টেকনিক্যাল শিক্ষকের স্থলে আছে ২ জন আর ৮ জন নন-টেক শিক্ষকের জায়গায় আছে ৩ জন। নেই ছাত্রাবাস। ছাত্ররা সঙ্কট নিরসনে দফায় দফায় আন্দোলন করছে। কিন্তু শিক্ষকরা বললেন, বার বার লিখিত আবেদন করেও আমরা শিক্ষক আনতে পারছি না। এ ছাড়া দিনাজপুর পলিটেকনিকে আর্কিটেকচার এ্যান্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন, রাজশাহীর মেকাট্রানিক্স,
যশোরে টেলিকমিউনিকেশন বিভাগ চলছে কোন শিক্ষক ছাড়াই। অন্তত ৭০টি বিভাগে কোন বিভাগীয় প্রধান বা চীফ ইনস্ট্র্রাক্টর নেই। দু বছর আগে শিক্ষকদের সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বছরের পর বছর
ধরে তৈরি হওয়া সঙ্কটের অবসানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব দেশের পলিটেকনিক
ইনস্টিটিউটে বছরের পর বছর ধরে চলা চরম শিক্ষক সঙ্কটের সমাধান করবে সরকার। নিয়োগ
দেয়া হবে প্রয়োজনীয় শিক্ষক। পলিটেকনিকে শিক্ষক- কর্মচারীদের শূন্যপদ পূরণ, তাদের
সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি, ছাত্রীদের আবাসন সঙ্কট সমাধান, পাঠক্রম যুগোপযোগী করার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন করা হবে। একই সঙ্গে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, আমাদের কারিগরি শিক্ষা খাত বছরের পর
বছর ধরে অবহেলার শিকার। দেশের স্বার্থেই এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু এখন হতাশ শিক্ষক
ও শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির (বাপশিস) সভাপতি মোঃ ইদ্রিস
আলী হতাশা প্রকাশ করে বললেন, পলিটেকনিক শিক্ষা বিভাগ সবচেয়ে অবহেলিত। কিন্তু দেশ
গড়ার কাজে এর গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষক ছাড়াই দ্বিতীয় শিফটের যাত্রা হয়েছে।
ফলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ডাবল শিক্ষার্থী পড়াতে হচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার্থী বেড়ে হয়ে যায় দ্বিগুণ। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষক সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। বিঘ্ন ঘটছে ক্লাস পরিচালনায়। তাছাড়া অর্ধেকের বেশি টেকনিক্যাল স্টাফের পদও শূন্য। এ অবস্থায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর
শিক্ষাজীবন কাটছে হতাশা আর উদ্বেগের মধ্যে। যদিও ডিজিটালবাংলাদেশ গড়তে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা আরও যুগোপযোগী, আধুনিক ও গতিশীল করার কথা বলা হয়। তিনি আরও
বলেন, শিক্ষক সঙ্কট ও পদোন্নতির জটিলতা কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি বাস্তবায়নে যে কোন
সাংঘর্ষিক আন্দোলনে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রবীণ এই
শিক্ষক নেতা। অন্যদিকে সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্মল চন্দ্র সিকদার বলেন, কারিগরি শিক্ষাকে দক্ষ
জনশক্তি তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে অভিহিত করা হলেও এ খাতই সবচেয়ে বেশি অবহেলার
শিকার। সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষক সঙ্কট নিয়ে ডাবল শিফট চালু, বেতন না পাওয়া, ক্লাস না হওয়া, শিক্ষক ছাড়া বিভাগ খুলে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণেই সঙ্কট
চরম আকার ধারণ করেছে।
(তথ্যসূত্র দ্যা ডেইলি জনকন্ঠ ২৬-মে-২০১২)
AVABE AKTA SIKKA BEBOSTA COLTE PARENA,SO AKONY SOMOI JAGRATO HOAR,NIJEDER DABI ADAI KORAR
উত্তরমুছুন